স্থির ও বহমান পানির জলাশয়ের লিমনোলজিকাল( Limnological) সমস্যাগুলো কি কি?  


What are the limnological problems of still and flowing water bodies
?


স্থলভাগ দ্বারা পরিবেষ্টিত স্থির পানির জলাশয়ের পানির উৎস বৃষ্টি এবং ভূগর্ভস্থ পানি। এ ধরনের জলাশয় মাও চাষের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। কারণ- আয়তনে ছোট এবং স্রোতবিহীন হওয়ায়, এ ধরনের জলাশয়ের বিভিন্ন সমস্যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

 স্থির পানির জলাশয়ের Limnological সমস্যাগুলো নিম্নরূপ-


(i) পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন এর পরিবর্তন (Change of Dissolve O_{2} in Water):

 মাছ চাষের ক্ষেত্রে O_{2} একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে চিহ্নিত হয়। বিভিন্ন পরিবেশীয় কারণে জলাশয়ে O_{2} এর স্বাভাবিক মাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। এই পরিবর্তনশীলতা পানির উৎপাদনশীলতাকে নষ্ট করে। এর ফলে মাছ চাষে বিরাট সমস্যার সৃষ্টি হয়।


(ii) Photoperiodism এর ভূমিকা (The Role of Photoperiodism):

জলজ জীবের জীবনধারণের জন্য আলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দিবাভাগে জলাশয়ে আলোর প্রাপ্যতা, দিনের দৈর্ঘ্যের ব্যাপ্তির উপর নির্ভরশীল থাকে। এই বিষয়টিকে Photoperiodism বলে। ঋতু পরিবর্তনের কারণে স্থির পানির জলাশয়ে Photoperiodism এ ভিন্নতা দেখা দেয়। এর ফলে জলাশয়ের বাস্তুতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটায় মাছ চাষে সমস্যা সৃষ্টি হয়। যেমন- গ্রীষ্ম কালে দিনের দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় অতিরিক্ত সূর্যতাপে অনেক জলজ উদ্ভিদ ও মাছের জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটে। অন্যদিকে শীতকালে দিনের দৈর্ঘ্য ছোট হওয়ায়, প্রয়োজনীয় ডাপমাত্রার অভাবে মাছের উৎপাদন হ্রাস পায়।


(ⅲ) কার্বনডাইঅক্সাইড এর অধিক ঘনত্ব (Higher Concentration of Carbondi Oxaid ) : 

জলাশয়ে কার্বনডাইঅক্সাইড এর অধিক ঘনত্ব প্রতিটি জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। জলাশয়ে জলজ উদ্ভিদের অত্যাধিক উপস্থিতি এবং জলাশয়ের তলদেশে পচনশীল জৈব বস্তু থেকে নির্গত কার্বনডাই অক্সাইড অনেক সময় পানিতে কার্বনডাই অক্সাইড এর ঘনত্ব বৃদ্ধি করে। প্রতি লিটার পানিতে ১৫ mg কার্বনডাই অক্সাইড এর উপস্থিতি মাছের স্বাভাবিক জীবনযাপনে সহায়তা করে। এর অতিরিক্ত কার্বনডাই অক্সাইড জলাশয়ে বিরূপ প্রভাবের সৃষ্টি করায় মাছ চাবে সমস্যা দেখা দেয়।


(iv) পানিতে pH এর বিভিন্নতা (Differentiation of pH in Water): 

পানিতে pH এর মাত্রা, পানির অম্লীয় বা ক্ষারীয় অবস্থাকে নির্দেশ করে। পানির pit ৭ এর অধিক হলে ক্ষারীয় অবস্থা এবং ৭ এর নিচে হলে 'অম্লীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। পানির অধিক অম্লীয় এবং ক্ষারীয় প্রকৃতি মাছ চাষের জন্য ক্ষতিকর। মাছ চাষের জন্য উপযোগী pH এর মাত্রা ৬.৫-৮.৬। এই মাত্রার ব্যতিক্রম হলে মাছের স্বাভাবিক জীবনধারায় বিঘ্ন ঘটে এবং মাছ চাষে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়।

(v) পানি দূষণ (Water Pollution): স্থির পানির জলাশয়ে প্রবহমানতা না থাকায়, বিভিন্ন দূষিত পদার্থ


পানিতে মিশ্রিত হয়। এছাড়াও ভৌত রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে পানির স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়। অনেক সময় বিভিন্ন ক্ষতিকর পরজীবির সংখ্যাধিক্যের কারণেও পানি দূষিত হয়ে পড়ে। পানি দূষণের কারণে পানিতে অণুজীবের সংক্রমন ঘটে এবং চাষকৃত মাছ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।


(vi) প্ল্যাংকটন ও বেনথোস এর অনিয়মিত উপস্থিতি (Irregular Presence of Plankton and Benthos): 

জলাশয়ে বিদ্যমান উদ্ভিদ এবং প্রাণী প্ল্যাংকটন মাছ চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদ্ভিদ


প্ল্যাংকটন প্রাথমিক উৎপাদক হিসাবে পানির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য সরবরাহে অংশ নেয়। মাছের অন্যতম প্রাথমিক খাদ্য হিসাবে প্রাণী প্ল্যাংকটন বিবেচিত হয়। জলাশয়ের তলদেশে অবস্থানকারী বেনঘোস জীবগোষ্ঠী বিভিন্ন জৈব পদার্থকে বিয়োজনের মাধ্যমে মাছের ব্যবহার উপযোগী করে তোলে। সুতরাং জলাশয়ে পরিমিত ও নিয়ন্ত্রিতভাবে প্ল্যাংকটন ও বেনথোস জীবের উপস্থিতি মাছ চাষের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। এর ব্যতিক্রম হলে মাছ চাষে সমস্যা দেখা দেয়।


(vii) পানির বহুবিধ ব্যবহার (Various Uses of Water):

স্থির পানির বন্ধ জলাশয় (যেমন- পুকুর, দীঘি) গুলোর অধিকাংশই ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে এইসব জলাশয়ের পানি ব্যবহৃত হয়। থালাবাসন ধোয়া, কাপড় কাঁচা, গোসল এমনকি গরু-বাছুর গোসলের কাজও এখানে সম্পন্ন হয়। এইসব কারণে জলাশয়ের পানি ময়লা ও দূষিত হয়ে পড়ে। ময়লা ও দূষিত পানি মাছ চাষে প্রতিকূল প্রভাবের সৃষ্টি করে। উপরোক্ত কারণগুলো ছাড়াও জলাশয়ের অবস্থান, ভূ-প্রকৃতি, মাটির ধরন, জলাশয়ে অবাঞ্চিত শিকারি মাছের উপস্থিতি, অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি পানির গভীরতা প্রভৃতির কারণেও মাছ চাষ বা মাছের উৎপাদনশীলতা প্রভাবিত হয়।

প্রবহমান পানির জলাশয়ে মাছ চাষে Limnological সমস্যাসমূহ (Limnological Problems of Fish Culture in Lotic Water Bodies)


স্বাদুপানির বা লবণাক্ত পানির ছোট-বড় নদী, ঝর্ণা, খাল ইত্যাদি প্রবহমান জলাশয় হিসাবে পরিচিত। এ ধরনের জলাশয় অনেক বড় এলাকা জুড়ে অবস্থিত হওয়ায়, এর পরিবেশকে কখনোই সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় না। এর ফলে মাছ চাষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যাগুলো নিম্নে বিভিন্ন শিরোনামে বর্ণনা করা হলো-


(1) স্রোতের পরিবর্তন (Change of Current): মাছের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে স্রোত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। স্রোতের মাধ্যমে পানির মিশ্রণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ায়, পুষ্টি উপাদানসমূহ জলাশয়ের প্রতিটি স্তরে পৌঁছায়। অন্যদিকে নির্দিষ্ট ও নিয়মিত স্রোতের সাথে নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছ অভিযোজিত হয়ে বাস করে। কোনো কারণে স্রোতের গতি ও মাত্রার পরিবর্তন হলে, পানির ভারসাম্য নষ্ট হয়। এর ফলে মাছ চাষে বিরূপ প্রভাব পড়ে।


(২) পানির অতিরিক্ত ঘোলাত্ব (Excess Turbidity of Water): সাধারণভাবে স্রোতের কারণে প্রবহমান জলাশয়ের পানি ঘোলা থাকে। কিন্তু ঘোলাত্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে ঘোলা পানিতে সূর্যের আলো প্রবেশে ব্যাঘাত ঘটে। এর ফলে পানির তাপমাত্রা কমে যায় এবং জলাশয়ের উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ হ্রাস পায়। এই অবস্থায় মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ায়, চাষকৃত মাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।


(৩) অক্সিজেন এর আধিক্য বা অভাব (Excess or Scarcity of O₂): পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিক সীমা অতিক্রম করলে পানিতে ০ এর পরিমাণ হ্রাস পায়। এর ফলে মাছসহ জলজ প্রাণীর শ্বসন জটিলতা দেখা যায়। অন্যদিকে জলাশয়ে উদ্ভিদ প্ল্যাংকটনসহ জলজ উদ্ভিদের আধিক্যের কারণে পানিতে দ্রবীভূত ০২ এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত ০, এর প্রভাবে মাছ গ্যাস বুদবুদ রোগে আক্রান্ত হয়। জলাশয়ের পানিতে ৫.০-৬.০ PPPM মাত্রায় ৩, দ্রবীভূত থাকলে মাছের বৃদ্ধির হার বেশি হয়।


(iv) আন্ত: প্রজাতিক সম্পর্ক (Inter Specific relation): প্রবহমান জলাশয়ে এক সাথে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বাস করায় এদের মধ্যে খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য প্রতিযোগিতা হয়। এই প্রতিযোগিতার ফলে অধিকাংশ মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এইসব প্রজাতির মাছেরা কেউ খাদ্য এবং কেউ খাদক হিসাবে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। খাদক বেশি হলে খাদ্য ফমে যায় এবং খাদ্যের অভাবে খাদক মাছ মৃত্যুবরণ করে।


(v) ব্যবস্থাপনার সমস্যা (Problems in Management): বাংলাদেশের প্রবহমান জলাশয়গুলো আকারে বড় হওয়ায় সঠিক ব্যবস্থাপনায় সমস্যার সৃষ্টি হয়। মৎস্য সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগে ব্যর্থতা, অত্যাধিক মৎস্য আহরণ, মৎস্য চারণ ক্ষেত্রসমূহের সংরক্ষণে জটিলতা, সঠিক পরিকল্পনার অভাব এবং মৎস্য ক্ষেত্রগুলোতে মাছ চাষের জন্য প্রকৃত মৎস্যজীবিদের নিয়োজিত না করায়, প্রবহমান পানিতে মাছ চাষে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত হচ্ছে না।


স্থির ও প্রবহমান পানির জলাশয়ে মাছ চাষে Limnological যে সমস্যাগুলো উল্লেখ করা হলো, সেগুলো পারিকল্পিতভাবে সমাধান করা হলে মাছের উৎপাদন মাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং মাছ চাষে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জিত হবে

Leave a Comment